পুতুল নাচের ইতিকথা
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্মপত্রিকায় তাঁর নামরাখা হয়েছিল অধরচন্দ্র। তার পিতার দেওয়া নাম
ছিল প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের
চরম সংকটময় মূহুর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে
কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগতে নতুন এক
বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ফ্রয়েডীয়
মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব
দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার
রচনায় ফুটে উঠেছে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে
তিনি রচনা করেন বিয়াল্লিশটি উপন্যাস ও দুই
শতাধিক ছোটোগল্প। খ্যাতির বিড়ম্বনার কারণে
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে
অনার্সে ভর্তি হইয়াও পড়ালেখা চালাইয়্যা
যাইতে পারেন নাই। বন্ধুর সাথে বাজী ধইরাই
লিইখ্যা ফেলেন প্রথম গল্প "অতসী মামী"। ১৯৪৪
সনে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এ
সময় থেইক্যা তাঁর লেখায় কম্যুনিজমের প্রভাব
লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর্থ-
সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের
ভাঙ্গা গড়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে তিনি
তাঁর সাহিত্যে চিত্রায়িত করেছেন। মৃগীরোগে
আক্রান্ত লেখক জীবনের শেষদিকে তীব্র আর্থিক
কষ্টে ভুগে দীর্ঘদিন রোগভোগের পর ৩রা
ডিসেম্বর ১৯৫৬ সনে মৃত্যুবরণ করেন।
তার মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল
পূর্ববঙ্গের গাউদিয়া গ্রামে। এই গ্রামটির পটভূমি
তিনি রচনা করেন তার আলোচ্য "পুতুলনাচের
ইতিকথা" উপন্যাসে।
বইটিতে মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছেন,এক গ্রাম্য
যাপিত-জীবনের গল্প।আপাত দৃষ্টিতে যাকে
বৈচিত্র্যহীন,সঙ্কীর্ণ স্বকেন্দ্রিক বলে ভুল হয়।
কিন্তু মানিক দেখিয়েছেন এর মাঝেও আছে কত
বৈচিত্র্য, কত রহস্য,ক্ষুদ্র-বৃহৎ ঘটনা প্রবাহের কত
বিশাল প্রভাব সেখানকার মানুষগুলোর জীবনে।
তারা বাস করে এক ঘোর লাগা জীবনে।সেখানে
নিজেদের জীবন কেউ পরিবর্তন করতে পারেনা।
নিজেদের সৃষ্ট সুতোর জালে নিজেরাই আটকে পড়ে
অনেকটা পুতুলের মত নেচে যায় তারা অদৃশ্য কোন
শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।
উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদেই একটি পুতুলের
অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। বকুল তলায় পড়ে-থাকা
ন্যাকড়া-জড়ানো পুতুলটি যে শ্রীনাথের মেয়ের
পুতুল, তা বুঝতে পারে ডাক্তার শশী। আর সে এও
অনুভব করতে পারে যে, ভোর বেলায় গ্রামের
মেয়েরা পুতুলটিকে দেবতা-প্রেরিত বলে ভেবে
নেবে। বলা যায়, একরকমভাবেই ঔপন্যাসিক শশী
এবং গ্রামবাসীর মধ্যকার পার্থক্যের সুতো বেঁধে
দেন।
শশী-কুসুম সম্পর্ককে শারীরবৃত্তীয় জটিলতা থেকে
ঊর্ধ্বে নিয়ে দেখিয়েছেন, মন মানুষের জটিলতার
কেন্দ্র, শরীর কেবল বাহ্যিক আবরণ।
শশীকেন্দ্রিক মূল কাহিনীর সঙ্গে অন্য দুটি শাখা
কাহিনী আছে একটি মতি-কুমুদের, আরেকটি বিন্দু-
নন্দলালের। সহোদরা বিন্দু আর প্রতিবেশিনী
মতির বিপুল পরিবর্তন ওইসব চরিত্রের চলিষ্ণুতারই
সাক্ষ্য দেয়। শশী চরিত্রের মুখ দিয়ে, চোখ দিয়ে,
অন্তর দিয়ে উত্তম পুরুষে বর্ণিত উপন্যাসটি।
জীবনকে দেখার, বোঝার আর প্রকাশ করার ভঙ্গি
মানিকের স্বতন্ত্র। যেন কোনো কিছুকেই এড়িয়ে
যাওয়া তার চলে না। ঘটনার ডিটেইলস কিংবা
অনুভবের গভীরতা তার উপন্যাসের প্রাণবস্তু।
বরাবরই ফ্রয়েডীজম দ্বারা আক্রান্ত মানিকের এই
উপন্যাসে সার্ত্রে কিংবা কাম্যুর মত
অস্তিত্ববাদের ও বেশ খানিকটা ছোঁয়া দিয়ে
গেছেন মানিক।সম্পূর্ণ আমাদের সমাজভিত্তিক।
সেই সাথে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়ে গেছেন
সমাজের বেশ কিছু গেড়ে বসা দর্শনকেও ।
মানিকে জীবন বহু মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে।
এখানে সকলেই পুতুল: হারুর শবদেহ থেকে পরান,
যামিনী কবিরাজ, সেনদিদি, গোপাল, বিন্দু,
সবাই। তবে গভীরতার বিচারে অতলগামী
মানিকের সব চরিত্রেই যেন স্বাভাবিক।
বজ্রাঘাতে হারু ঘোষের মৃতদেহ আবিষ্কার-দৃশ্য
দিয়ে উপন্যাসের শুরু আর মাটির টিলার ওপর উঠে
শশী ডাক্তারের সূর্যাস্ত-দর্শনের শখের অতৃপ্ততা
দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি। এরই মধ্যে দশ বছরের
কালপরিসরে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন চরিত্রের
নিয়তির প্রতি আত্মসমর্পণ ও বিদ্রোহের ইতিকথা।
"বারবার প্রশ্ন করেন লেখক। প্রচুর প্রশ্নবোধক চিহ্ন
ব্যবহার করেছেন এ উপন্যাসে। বিজ্ঞানের ছাত্র
বলেই জীবন-সত্যকে তিনি আবিষ্কার করতে
চেয়েছেন প্রশ্নের বাঁধ দিয়ে।"
বস্তুত কয়েকটি খণ্ড ‘এপিসোড’ সৃষ্টি করেছেন
লেখক, আর নায়কের মনে সেসব ঘটনা যে ভাবনার
প্রতিফলন ঘটিয়েছে তা-ই সমগ্র উপন্যাসে এক
ধরনের বন্ধনহীন গ্রন্থি রচনা করেছে। লেখক এ
ধরনের উক্তি নানা অনুষঙ্গেই করেছেন- ‘শশী
ভাবে, ভাবিয়া অবাক হয়…’-প্রকৃতপক্ষে ঘটনার
প্রকাশ্য পথ দিয়ে নয়, ভাবনার অন্তর্গূঢ় পথ বেয়েই
শশী জীবনের অসীম বিস্ময় ভরা রহস্যময় স্বরূপের
জগতে পৌঁছানোর প্রয়াস পায়।
উপন্যাসে অসাধারণ সব ঘটনা সাধারণ জীবনের
সাথে মিশে যায়। মনে হয় না বানানো কথা, মনে
হয় রোজকার কথাই, আমার দেখার চোখ নেই বলে
এমন দেখিনা।