বিএনপি : সময় অসময়
by মহিউদ্দিন আহমেদ
সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়ে লেখা অনেক
চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশে বেশিরভাগ লেখকই
সাম্প্রতিক ইতিহাসের উপর লিখতে গিয়ে স্রেফ
পত্রিকার কলামই লিখেন। সময়ের উত্তাপ সেখানে
হয়তো থাকে কিন্তু গভীর উপলব্ধি সেখানে
অনুপস্থিত।
লেখক:মহিউদ্দিন আহমেদ
গবেষক ও সাবেক জাসদ কর্মী মহিউদ্দিন আহমদের
সাথে দ্বিমত প্রকাশ করার অনেক জায়গা থাকলেও
তাকে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য করা ঠিক হবে
না। কারণ পক্ষ-বিপক্ষ সীমানার বাইরে দাড়িয়ে
তিনি তার সময়কে ধারণ করতে চেয়েছেন। তিনি
কতটুকু সফল হয়েছেন সেটাও ইতিহাস নির্ধারণ
করবে।
মহিউদ্দিন আহমদের ‘বিএনপি সময় অসময়’ বইটিতে
বিএনপির ভ্রুণাবস্থা থেকে শুরু করে একেবারে
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ও ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির
নির্বাচন পরবর্তী বিএনপিকে নিয়ে পর্যালোচনা
এসেছে।
মেজর জিয়াউর রহমান
বিএনপির জন্ম সেনাছাউনিতে, একজন
সেনানায়কের হাতে, যখন তিনি ছিলেন ক্ষমতার
কেন্দ্রে । এ ধরণের রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্ত
থেকে ছিটকে পড়লে সাধারণত হারিয়ে যায় ।
বিএনপি এ দিক থেকে ব্যতিক্রম । দলটি শুধু টিকেও
যায়নি, ভোটের রাজনীতিতে বিকল্প শক্তি
হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দেশে গণতন্ত্র আছে
কিনা, বিএনপিতেও গনতন্ত্রের চর্চা হয় কিনা তা
নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলা যায় । কিন্তু
দলটি দেশের
জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে,
এটা অস্বীকার করার জো নেই । বিএনপির সুলুক
সন্ধান করতে হলে আমাদের যেতে হবে একাত্তরে
। জানতে হবে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের
মনস্তত্ত্ব। পচাত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনা প্রবাহকে
এড়িয়ে গিয়েও বিএনপি কি ষড়যন্ত্রের ফসল নাকি
এর উত্থান ছিল অনিবার্য । লেখক-গবেষক
মহিউদ্দিন আহমেদ এই বইয়ে দলটির একটি
সুরতহালের প্রচেষ্টা করেছেন । প্রথমবারের মতো
এই বইয়ে উঠে এসেছে জানা-অজানা নানা প্রসঙ্গ,
যা একদিন ইতিহাসের উপাদান হবে।
মহিউদ্দিন আহমদের ‘বিএনপি সময় অসময়’ বইটিতে
বিএনপির ভ্রুণাবস্থা থেকে শুরু করে একেবারে
ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ও ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির
নির্বাচন পরবর্তী বিএনপিকে নিয়ে পর্যালোচনা
এসেছে।
মহিউদ্দিন আহমেদ দেখিয়েছেন কিভাবে
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ধারা ও
উপধারার মধ্যে পার্থক্য সূচিত হচ্ছিল এবং
স্বাধীনতার পর সে পার্থক্য বড় আকারে দেখা
দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় জাসদের উত্থান-পতন
হয় এবং দেশে বিএনপি নামে আরেকটি বড়
রাজনৈতিক প্রপঞ্চের বিকাশ ঘটে।
অন্যান্য সামরিক শাসক যেমন পরিকল্পনা করে
ক্ষমতা দখল করেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর
রহমান সেটি করেননি। সামরিক-বেসামরিক যে
শক্তির যোগসাজশে ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয়েছে,
সেই শক্তিই তাঁকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তবে জিয়া
৭ নভেম্বর নিজে ক্ষমতা দখল না করলেও ক্ষমতা
পাকাপোক্ত করতে পূর্বসূরি আইয়ুবকেই অনুসরণ
করেছেন। প্রথমে তিনি গণভোট দিয়েছেন, তারপর
বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে দল ও ফ্রন্ট
গঠন করেছেন এবং একক কর্তৃত্বে দল ও দেশ
চালিয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়া
ততটুকুই গণতন্ত্র দিয়েছেন, যতটুকু তাঁর ক্ষমতাকে
নিরাপদ রাখে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির আগমন
অনিবার্য ছিল কি না, তা নিয়ে তর্ক থাকতে
পারে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার
সুযোগের সদ্ব্যবহার কোনো বাম দল করতে পারলে
হয়তো ডানপন্থী বিএনপি নিজেকে একমাত্র
বিকল্প রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে
পারত না। কিন্তু বামদের অনুপস্থিতি কিংবা
দেউলিয়াত্বের কারণে বিএনপির আগমন ঘটে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যেমন একসময়
আওয়ামী লীগকে দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল,
তেমনি জাসদ জিয়ার কাঁধে বন্দুক রেখে সিপাহি
জনতার বিপ্লবের খোয়াব দেখেছিল।
মহিউদ্দিন আহমদ এই বইয়ে কেবল বিএনপির সময়-
অসময় বর্ণনা করেননি। বাংলাদেশের রাজনীতির
সময়-অসময়ও বিবৃত করেছেন। অসময় থেকে
রাজনীতিকে সময়ে নিয়ে আসার দায়িত্বটি যে
রাজনীতিকদেরই, সে কথাটি তাঁরা প্রায়শ ভুলে
যান। তাঁরা ভাবেন বিরোধী পক্ষকে কথায় ঘায়েল
করতে পারলেই বড় দেশপ্রেমিক হওয়া যায়। কিন্তু
তাঁরা পূর্বসূরির চেয়ে উন্নত কোনো শাসন উপহার
দিতে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
লেখকের মাঝে নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ার
চাইতে রেফারেন্স দিয়ে প্রমাণ দেয়ার প্রবণতাটা
বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
জিয়ার মৃত্যুর পরের সময় টুকু খুব তড়িঘড়ি করে শেষ
করেছেন। এখান্টায় আরো একটু বিশদ আলোচনা
প্রয়োজন ছিল।
বিএনপি নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ উঠে
এসেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রে ও
সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বিএনপি প্রতিষ্ঠিত
হলেও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে
অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশে পাকাপোক্ত
রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
রাজনীতির মাঠে তেমন কোন পূর্বাভিজ্ঞতা না
থাকলেও গৃহবধু থেকে রাজনীতির মাঠে বেশ
কারিশমা দেখিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।
রাজনীতির মাঠে ‘আপোষহীন’ খুবই অর্থহীন শব্দ।
একজন ভালো শাসক বা নেতাকে বিভিন্ন সময়ে
বিভিন্ন আচরণ করতে হয়, অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা
নিতে হয় আর নিজেকে সময়ের সেরা অস্ত্র ও
আইডিয়া দিয়ে আপডেট করতে হয়। বইটি পড়ে মনে
হলো বেগম খালেদা জিয়া একই অস্ত্র, একই
রাজনৈতিক ভাষা, একই রাজনৈতিক কর্মসূচী
এরশাদ বিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে এখনো
ব্যবহার করে আসছেন।
ক্ষমতায় থাকাকালে বেগম খালেদা জিয়া ও তার
দলের অবস্থা ভিন্ন থাকে। গণতান্ত্রিকভাবে
প্রথমবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে অনেককিছু
করতে পারলেও ক্ষমতায় পাকাপোক্তভাবে থাকার
খুটি অনুসন্ধান ছাড়া বড় কিছু করতে পারেননি।
ইতিহাস তাকে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার সুযোগ দিলেও
প্রথম টার্ম ও দ্বিতীয় টার্মে ফেইল করেছেন।
দলীয় চেলা-চামুণ্ডাদের পকেটভারি করা সহ জিয়া
পরিবারের বিপুল অর্থ-বিত্ত সমাগম ঘটলেও
রাজনীতিতে ভালো কিছু সংস্কৃতির প্রচলন করতে
পারেননি।
১৯৯১ এ ক্ষমতায় আসার পর মাগুরা উপনির্বাচন
দিয়ে শুরু করে নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে
জেতার যে প্রচেষ্টা শুরু করেন সেটা চালিয়ে যান
২০০৬ সালেও। কিন্তু ইতিহাস খুব নির্মম! ক্ষমতায়
থাকাকালে নিজেরা যেভাবে ক্ষমতায় আকড়ে
থাকার চেষ্টা করেছিলেন, নামেমাত্র নির্বাচন,
নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে জেতার চেষ্টা
করেছিলেন তাদের প্রতিপক্ষ আজ তাদের বিপক্ষে
একই অস্ত্র ব্যবহার করছে।
ইতিহাসের বিভিন্ন সুন্দর, তিক্ত অভিজ্ঞতার
পালাক্রমে বিএনপি এখন কঠিন সময়ে।
"বিএনপি ভালো না খারাপ, সম্ভাবনাময় না
একেবারে শেষ হয়ে গেছে, এই তর্কের চেয়েও
গুরুত্বপূর্ণ হলো, দ্বিদলীয় রাজনীতিতে
নাগরিকদের জন্য ‘স্পেস’ থাকে। একটি দল যদি
নির্বাসনে যায়, অন্যটির তখন যা খুশি করার
প্রবণতা পেয়ে বসে। তৈরি হয় একচেটিয়া দলতন্ত্র।
বিএনপির বর্তমান অবস্থা এরকম একটা অস্বস্তিকর
অবস্থা তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। আখেরে এটা
কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। বিএনপি আবার
ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তার ওপর দেশের
আগামী দিনের রাজনীতি অনেকাংশে নির্ভর
করছে।’ (পৃ: ৩১৫)
মহিউদ্দিন
আহমদের ‘বিএনপি সময়-অসময়’ কেতাবটি
পড়লে অস্বস্তির ইতিহাসের সাথে পরিচিত
হওয়া যাবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন
রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে
অস্বস্তিতে পড়বে যখন দেখবে কীভাবে
আওয়ামী লীগের কারণেই দেশে আরেকটি
শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জেগে উঠা
অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। আবার বিএনপি
কিভাবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে
মারতে বর্তমান করুণ অবস্থায় এসে পরেছে
সেটা দেখে বিএনপি অস্বস্তিতে পড়বে।